প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার তিন কারণ
অর্থ ডেস্ক: গত আগস্টে দেশে আসা প্রবাসী আয় বেশ বড় পরিমাণে কমেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আগস্টে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ আয় কম এসেছে। সব মিলিয়ে এ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার, গত বছরের একই মাসে যার পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি ডলার। কোনো একক মাসে আয় এত কমে যাওয়ার ঘটনা সম্প্রতি ঘটেনি।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় নতুন করে চিন্তায় পড়েছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ডলার–সংকট নিয়ে এমনিতেই চাপে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রতিনিয়ত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রাখার শর্ত দিয়েছিল। বর্তমানে তার চেয়ে কম রিজার্ভ রয়েছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, আগের চেয়ে সম্প্রতি ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, ফলে আমদানি দায় মেটাতে ভবিষ্যতে আরও বেশি ডলারের প্রয়োজন হবে। আবার সামনে সরকারি-বেসরকারি ঋণ পরিশোধও বাড়বে। তাই এমন সময়ে প্রবাসী আয় এতটা কমে যাওয়া সবার জন্য উদ্বেগের, আতঙ্কের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়তে না দিয়ে স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে শক্তিশালী করে রাখা হয়েছে, তাতে প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। এই নীতি কোনোভাবেই কার্যকর হচ্ছে না। শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি মানতে চাইছেন না, ফলে রিজার্ভেরও পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) মিলে রপ্তানি, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে সংগঠন দুটি প্রায় প্রতি মাসে ডলারের দাম নতুন করে নির্ধারণ করছে। তবে কাজটি করার ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদা ও জোগান কতটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
চলতি মাস থেকে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। এর আগে প্রবাসী আয়ের ডলার ১০৯ টাকায় বিক্রি করা যেত। কিন্তু খোলাবাজারে নগদ ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে, এখন বিদেশি এই মুদ্রা বিক্রি হচ্ছে ১১৭-১১৮ টাকায়।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে বাজারদর অনুযায়ী ডলারের বিনিময় হার ঠিক করতে হবে। বর্তমানে নির্ধারিত বাজারদরের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। খোলাবাজার ও নির্ধারণ করা দামের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। এই অবস্থা যত দিন চলবে, তত দিন আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয় বাড়বে না।
আনিস এ খান আরও বলেন, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক বা ভাসমান করে দেওয়া উচিত। আইএমএফও তাদের বিভিন্ন বার্তায় এটা করতে বলেছে। ডলারের দাম ভাসমান করা হলে প্রাথমিকভাবে হয়তো ডলারের দাম বাড়বে, হয়তো ১২০-১৩০ টাকায় চলে যাবে। তবে একপর্যায়ে তা ঠিক হয়ে যাবে।
দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ অবশ্য একেবারে নতুন নয়। এই আয় বা রেমিট্যান্স কিছুদিন ধরেই কমছে বা খানিকটা ওঠানামার মধ্যে আছে। তবে ছয় মাসের মধ্যে গত আগস্টেই প্রবাসী আয় এসেছে সবচেয়ে কম। ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে।
প্রথমটি হলো, ব্যাংকগুলোতে কী দামে ডলার কেনা ও বেচা হচ্ছে, তা যাচাইয়ের জন্য আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি পরিদর্শক দল কিছু ব্যাংক পরিদর্শন করেছে। এ কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দরে প্রবাসী আয় কিনতে পারেনি। দেখা গেছে, যেসব ব্যাংকে পরিদর্শক দল যায়নি, ওই ব্যাংকগুলোর কয়েকটির মাধ্যমে প্রবাসী আয় বেশি এসেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কড়াকড়ির কারণে সামগ্রিকভাবে প্রবাসী আয় কম এসেছে।
দ্বিতীয়ত, আগস্ট মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর আড়াই শতাংশ সরকারি প্রণোদনা ধরে হয় সর্বোচ্চ ১১১ টাকা ৭২ পয়সা। তবে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এ সময় হুন্ডির মাধ্যমে আসা প্রতি ডলারে ১১৭-১১৮ টাকা দাম পাওয়া গেছে। এই কারণেও আয় কমেছে।
তৃতীয় কারণটি হলো, জুনের শেষে কোরবানি ঈদ ছিল। এরপরের কয়েকটি মাসে এমনিতেই কম অর্থ দেশে পাঠান প্রবাসীরা। কারণ, কোরবানির সময় অনেকেই দেশে আসেন। এরপর বিদেশে ফিরে যেতে দু-তিন মাস সময় লেগে যায়। আবার নতুন অনেক জনশক্তি রপ্তানি হলেও আয় পাঠাতে তাঁরা প্রায় ছয় মাস সময় নেন। কারণ, চাকরি ও কাজ পেতে সময় লাগে। আবার বিদেশে গিয়ে থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাতে অনেকে হিমশিম খান। এর ফলে সামগ্রিকভাবে আয় কমে গেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো একক মাসে প্রবাসী আয় এত কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনক। কারণ, এখন ডলারের খুবই প্রয়োজন। দেশের আর্থিক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে আছে, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা হলে প্রবাসী আয় বাড়বে। আমার মনে হয়, পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’