দলিত যুব ও যুব নারীদের জন্য কমিউনিটি মিডিয়া ফেলোশিপ

 

করোনা পরবর্তী নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বৈষম্য দূরীকরণ ও প্রয়োজনীয় সেবাতে দলিত ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

কমিউনিটি মিডিয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের যুব ও যুব নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং করোনা সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি ত্রান ও চিকিৎসা সেবায় ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দলিত ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর সুবিধা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এন্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি) স্থানীয় পর্যায়ে সম্ভাবনাময় দলিত যুব ও যুব নারীদের জন্য ১০ ব্যাচে ফেলোশিপ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড-এর সহায়তায় পরিচালিত তিন মাস ব্যাপী ( জুন-আগস্ট ২০২০) কর্মসূচির আওতায় দেশের ৯টি কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারভূক্ত এলাকার মোট ১৮ জন দলিত ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের যুব ও যুব নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি স্থানীয় কমিউনিটি রেডিও’র সাথে যুক্ত হয়ে কমিউনিটি মিডিয়া সাংবাদিকতায় দক্ষতা অর্জন করছে।

বর্তমানে ফেলোরা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে সরকারি ত্রান ও চিকিৎসা সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত সুবিধা সম্পর্কে কমিউনিটি রেডিও ও সোস্যাল মিডিয় তথা ফেসবুকে অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রতিবেদন প্রচার করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও ফলো-আপের মাধ্যমে উক্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রাপ্তিতে সহায়তা করছে।

উল্লেখ্য ফেলোশিপের আওতায় ফেলোরা সংশ্লিষ্ট রেডিও’র একজন অভিজ্ঞ সম্প্রচারকারীর ত্বত্তাবধায়নে রেডিও ও সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক সম্পর্কিত সাক্ষরতা অর্জনের পাশাপাশি একজন সম্প্রচারকারী হিসেবে গড়ে উঠার জন্য সম্প্রচার পূর্ববর্তী ও পরর্বতী কার্যক্রম তথা- তথ্য সংগ্রহ ( ভক্স-পপ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ, স্ক্রীপ্ট লেখা, অডিও এবং ভিডিও ধারণ , সম্পাদনা, উপস্থাপনা, কনসোল মেশিন পরিচালনা এবং খবর পাঠ ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। এছাড়া স্থানীয় পত্রিকায় বা অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য সংবাদ/ফিচার/ প্রতিবেদন প্রস্তত করার কলা-কৌশল আয়ত্ত করেন।
১০ ব্যাচের ফেলো এবং সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি রেডিও স্টেশন হলো- মোঃ শাকিল আহমেদ, মো:রেজাউল করিম ( রেডিও নলতা, সাতক্ষীরা), নাসরিন জাহান রিয়া (রেডিও লোকবেতার, বরগুনা); সোমা দাশ এবং তমা মজুমদার (রেডিও সাগরগিরি, সীতাকুন্ড); মোসা: ফাতিমা তুজ জোহরা ও মো. আজিম আলী (রেডিও মহানন্দা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ); মো. তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, হানিফা খাতুন ও সিনথিয়া ইসলাম ( রেডিও মুক্তি, বগুড়া); রিমা আক্তার,মোঃ সাইদুর রহমান ও মোঃ মাইনুল ইসলাম (কৃষি রেডিও, বরগুনা); জেসমিন বেগম ও শারমিন বেগম ( রেডিও মেঘনা, ভোলা); শোভা রানী ও শ্রী সুজন চন্দ্র দাস ( রেডিও সারাবেলা, গাইবান্ধা) এবং মৌসুমী দাস ও মিনহাজুল ইসলাম ( রেডিও বড়াল, রাজশাহী)।

ইতোমধ্যে গত জুনে কৃষি রেডিওতে কর্মরত ফেলো রিয়া আক্তারের ‘করোনাকালে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের দলিত জনগোষ্ঠী’ এই শিরোনামে একটি সংবাদ রেডিও’র ফেসবুকে প্রচারিত হয়। সংবাদটি নজরে আসে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমতলীর সন্তান ড. অসীম কুমার সজ্জনের। পরবর্তীতে তার আর্থিক সহায়তায় স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় বেদে, কামার, নরসুন্দর এবং তৃতীয় লিঙ্গের মোট ১৫টি পরিবার ৫ টাকা দরে প্রতি মাসে ২০ কেজি চাল প্রাপ্তির আওতায় এসেছেন। এই সুবিধা আগামী ৬ মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। স্থানীয় পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের বর্তমান বাজার দর ৪৫ টাকা। সুবিধাভোগী পরিবারগুলো সে চাল পাচ্ছে মাত্র ৫টায়। সে মোতাবেক ১৫টি পরিবার আগামী ৬ মাস মোট ৭২,০০০ টাকার ( ৪০ টাকা ২০ কেজি ৬মাস ১৫ পরিবার) খাদ্য সহায়তা পাবেন।

উল্লেখ্য ফেলোশিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ফেলোদের সংবাদ প্রতিবেদন প্রচার ও নিয়মিত যোগাযোগ ও ফলো-আপের মাধ্যমে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে এ পর্যন্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দলিত ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মোট ৩৩১৪ জন মানুষের জন্য সর্বমোট ২,৭১,৮৯,৮০০ টাকা মূল্যমানের সুবিধা প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছে।

কমিউনিটি মিডিয়ায় দলিত যুব ও যুব নারীদের ফেলোশিপ কার্যক্রমটি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-১০ (অসমতা হ্রাসকরণ) অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

এছাড়া উক্ত ফেলোশিপ কার্যক্রমটি নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতার কাঠামোর ৪টি কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জনেও সহায়তা করছে। উদ্দেশ্যগুলো হলো-

দলিত যুব ও যুব নারীদের মানবিক সক্ষমতা বৃদ্ধি: ফেলোরা যেহেতু স্থানীয় এ দলিত ও অনগ্রসর সম্প্রদায় থেকে উঠে আসছে ফলে তারা সহজেই তাদের প্রতিবেদনে নিজস্ব কমিউনিটির প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তথ্য সরবরাহ করেন। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের আশা-আকাক্ষা, সুখ-দুঃখ , সংস্কৃতির বিষয়গুলো তুলে ধরনে। ইতোমধ্যে স্থানীয় মানুষের ভাষায় তাদের সুখ-দুঃখের গল্প তুলে আনায় ইউনিসেফ কর্তৃক মীনামিডিয়া অ্যাওয়ার্ড বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কার অর্জন করছেন ৫ জন নারী ফেলো ।

দলিত যুব ও যুব নারীর অর্থনৈতিক উপকার বৃদ্ধি : ফেলোশিপের মাধ্যমে রেডিওতে কাজ করার সুবাদে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সম্প্রচারকারী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন দলিত সম্প্রদায়ের যুব ও যুব নারীরা । বর্তমানে কমিউনিটি রেডিওতে (প্রযোজক, সহযোগী প্রযোজক, বার্তা সম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, প্রতিবেদক, উপস্থাপক হিসেবে) কর্মরত আছেন-৪৬ জন যুব ও যুব নারী। শুধু তাই নয় স্থানীয় পর্যায়ের রেডিওতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ফেলোদের অনেকেই এখন দক্ষতার সাথে কাজ করছেন মূলধারার গণমাধ্যম সহ সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে ।

দলিত নারীর কন্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি : প্রায় প্রতিটি রেডিওতেই কমিউনিটির দলিত ও অনগ্রসর নারীরা নিজস্ব কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি রেডিওগুলোতে নারীরা সমানতালে কাজ করে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলছেন। পল্লী অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের যে নারীদের কাছে এক সময় প্রযুক্তি ছিলো ভীতির বিষয়, তারাই এখন রেডিও স্টেশনের নানারকম যন্ত্রপাতি পরিচালনা করছেন। কম্পিউটারে দক্ষ হয়ে উঠছেন। নারীরা রেডিও স্টেশনের কনসোল অপারেট করছেন, অডিও -ভিডিও ধারন করছেন, সম্পাদনা ও উপস্থাপনা করছেন। এর ফলে স্টেশনে পুরুষ নির্ভরতা কমছে এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে আসছে।

দলিত যুব ও যুব নারীর উন্নয়নের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি : ফেলোশিপের মাধ্যমে দলিত নারীরা পাচ্ছেন সামাজিক স্বীকৃতি।তাদের সম্পর্কে পরিবারগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ আগ্রহ, বদলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ধারণা। এমনকি প্রথমদিকে রেডিও স্টেশনগুলোতে তথা রেডিও’র অন্যান্য সম্প্রচারকারীদের মধ্যে দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে ফেলোদের প্রতি যে এক ধরনের অনাগ্রহতা বা নেতিবাচক মনোভাব বিরাজ করত সেটাও দূর হয়েছে পুরোপুরি।

উল্লেখ্য ইতোমধ্যে এই কর্মসূচির আওতায় দেশের মোট ১৮টি কমিউনিটি রেডিওতে বিভিন্ন মেয়াদে ৯টি ব্যাচে সর্বমোট ১৫৯ জন স্থানীয় যুব ও যুব নারী সাংবাদিকতায় ফেলোশিপ গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ১১২ জনই এসেছে দলিত সম্প্রদায় থেকে ।

সর্বোপরি ফেলোশিপ কার্যক্রম সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘‘ফেলোশিপ ফর ইয়ুথ এন্ড ইয়ুথ উইমেন ইন কমিউনিটি মিডিয়া এন্ড জার্নালিজম” প্রকল্পটি জাতিসংঘ আয়োজিত তথ্য সমাজ বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন পুরষ্কার (WSIS) ২০১৬ অর্জন করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shares