জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার
সকালের ডাক ডেস্ক
জার্মান: Johannes Kepler) (২৭শে ডিসেম্বর, ১৫৭১ – ১৫ই নভেম্বর, ১৬৩০) একজন জার্মান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী। তিনি ১৭শ শতকের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত হয়ে আছেন কেপলারের গ্রহীয় গতিসূত্রের কারণে। পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁর লেখা আস্ত্রোনমিয়া নোভা, হারমোনিকেস মুন্দি এবং এপিতোমে আস্ত্রোনমিয়াই কোপেরনিকানাই বইগুলির মধ্যে লেখা নীতিগুলিকেই তাঁর সূত্র হিসাবে নামকরণ করেছেন। কেপলারের আগে গ্রহের গতিপথ জ্যোতিষ্কসমূহের খ-গোলক অণুসরণ করে নির্ণয় করা হত। কেপলারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন গ্রহগুলো উপবৃত্তাকার কক্ষপথ অণুসরণ করে। কেপলারের গ্রহীয় সূত্রগুলো আইজাক নিউটনের বিশ্বজনীন মহাকর্ষ তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। কর্মজীবনে কেপলার ছিলেন অস্ট্রিয়ার গ্রাৎস শহরে অবস্থিত একটি সেমিনারি স্কুলে গণিতের শিক্ষক যেখানে তিনি প্রিন্স হান্স উলরিখ ফন এগেনবের্গের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হন। এরপরে তিনি বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ট্যুকো ব্রাহের সহকারী হন এবং একসময় সম্রাট দ্বিতীয় রুডলফ এবং তার দুই উত্তরসূরী মাটিয়াস ও দ্বিতীয় ফের্ডিনান্ডের রাজগণিতবিদ হিসেবে কাজ করেন।
এছাড়া অস্ট্রিয়ার লিনৎস শহরে গণিত পড়িয়েছেন এবং জেনারেল ভালেনস্টাইনের উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি আলোকবিদ্যার মৌলিক নীতি নিয়ে কাজ করেছেন, প্রতিসরণ দুরবিনের একটি উন্নততর সংস্করণ নির্মাণ করেন যার নাম বর্তমানে কেপলারীয় দূরবিন এবং তার সমসাময়িক গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের দূরবিন বিষয়ক কাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেন। কেপলার যখন জীবিত ছিলেন তখন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল পদার্থবিজ্ঞানের। সেসময় পদার্থবিজ্ঞান ছিল প্রাকৃতিক দর্শনের একটি শাখা আর জ্যোতির্বিদ্যা ছিল লিবারেল আর্টসের অন্তর্ভুক্ত গণিতের একটি উপশাখা। কেপলারও তার আবিষ্কারগুলোকে ধর্মীয় যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি মনে করতেন ঈশ্বর একটি মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাকৃতিক কার্যকারণ অণুসন্ধানের মাধ্যমেই কেবল সেই পরিকল্পনার কিছুটা বোঝা সম্ভব।
এজন্য বোধহয় কেপলারের গবেষণাকর্মকে জ্যোতির্বিজ্ঞান না বলে জ্যোতির্বিদ্যা বলাই বেশি যুক্তিসঙ্গত হবে। তিনি তার নতুন জ্যোতির্বিদ্যার নাম দিয়েছিলেন খ-পদার্থবিদ্যা (celestial physics) যাকে বিবেচনা করা যেতে পারে এরিস্টটলের অধিবিদ্যার জগতে একটি বিশেষ অভিযাত্রা এবং এরিস্টটলের অন দ্য হ্যাভেনস গ্রন্থের উত্তরখণ্ড হিসেবে।[ মোটকথা, জ্যোতির্বিদ্যাকে সর্বজনীন গাণিতিক পদার্থবিদ্যার একটি শাখা হিসেবে বিবেচনা করে তিনি ভৌত বিশ্বতত্ত্বের সুপ্রাচীন প্রথাকে একটি নতুন আঙ্গিক দিয়েছিলেন **জীবনের প্রথম ভাগ ১৫৭৭ এর মহা ধূমকেতু। বাল্যকালে কেপলার এটি দেখেছিলেন।
ইউরোপ জুড়ে জ্যোতির্বিদদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিল এটি। জোহানেস কেপলার ১৫৭১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ভাইল ডেআ স্টাট নামক একটি ফ্রি ইমপেরিয়াল সিটি-তে জন্মগ্রহণ করেন। হলি রোমান এম্পায়ার-এ যে শহরগুলো কোন প্রিন্স নয় বরং সরাসরি সম্রাট কর্তৃক শাসিত হতো তাদেরকে ফ্রি ইমপেরিয়াল সিটি বলা হতো। বর্তমানে শহরটি জার্মানির স্টুটগার্ট অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
তার পিতামহ সেবাল্ড কেপলার এই শহরের লর্ড মেয়র ছিলেন, কিন্তু কেপলারের জন্মের সময় তার দুই ভাই ও এক বোন ছিল এবং তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল। তার বাবা হাইনরিশ কেপলারের ভাড়াটে সৈনিক জীবন ছিল আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভরপুর, অবশ্য তার বয়স যখন ৫ বছর তখন তিনি পরিবার ছেড়ে চলে যান। নেদারল্যান্ডে সংঘটিত আশি বছরের যুদ্ধে তিনি মারা গিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তার মা কাটারিনা গুল্ডেনমান ছিলেন সরাইওয়ালার মেয়ে, তিনি ভেষজ ঔষধ নিয়ে কাজ করতেন এবং ভিষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ডাকিনীবিদ্যা চর্চার অভিযোগে তার বিচার হয়েছিল।
গর্ভধারণের ৩৮তম সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগেই কেপলারের জন্ম হয়, যে কারণে শিশুকালে তিনি বেশ দুর্বল ছিলেন এবং নানা অসুখে ভুগতেন। অবশ্য মাতামহের সরাইখানার অনেক পথিককে সেই বয়সেই গণিতের দক্ষতা দেখিয়ে মুগ্ধ করে দিতেন। বেশ অল্প বয়সেই জ্যোতির্বিদ্যার সাথে পরিচিত হন এবং সারা জীবন জ্ঞানের এই শাখাটির প্রতি তার দুর্বলতা থেকে যায়। ৬ বছর বয়সে তিনি ১৫৭৭-এর মহা ধূমকেতু দেখেন, তার লেখা থেকে জানা যায় ধূমকেতুটি দেখার জন্য মা তাকে একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৫৮০ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে তিনি আরও একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন, এবার একটি চন্দ্রগ্রহণ। লেখা থেকে জানা যায় চন্দ্রগ্রহণ দেখার জন্য তাদেরকে বাইরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং চাঁদটি লাল দেখাচ্ছিল। কিন্তু শৈশবে গুটিবসন্ত রোগে তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ও হাত খোঁড়া হয়ে যায়। এ কারণে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিদ্যায় তার দক্ষতা বেশ কমে গিয়েছিল।
কেপলার প্রথমে গ্রামার স্কুল, পরে লাতিন স্কুল ও মাউলব্রোনে অবস্থিত ইভানজেলিক্যাল সেমিনারিতে (রোমান ক্যাথলিক যাজকদের প্রশিক্ষণ কলেজ) পড়া শেষে ইউনিভার্সিটি অফ ট্যুবিঙেনের ট্যুবিঙার স্টিফ্ট-এ ভর্তি হন। এখানে তিনি ফিটুস ম্যুলারের অধীনে দর্শন[ এবং ইয়াকব হিয়ারব্রান্ডের অধীনে ধর্মতত্ত্ব পড়েছেন।
হিয়ারব্রান্ড মিখায়েল মায়েস্টলিনকেও পড়িয়েছিলেন যিনি পরবর্তীতে ট্যুবিঙেনের উপাচার্য এবং কেপলারের বড় পৃষ্ঠপোষক হন। কেপলার এখানে চমৎকার গণিতবিদ এবং দক্ষ জ্যোতিষী হিসেবে খ্যাতি পান, এমনকি সহপাঠীদের রাশিচক্র গণনা করেও নাম কুড়িয়েছিলেন। মিখায়েল মায়েস্টলিনের দিক নির্দেশনায় তিনি গ্রহীয় গতি সম্পর্কে টলেমির ধারণা এবং কোপেরনিকুসের ধারণা দুটোই অধ্যয়ন করেন।
সে সময় কিছুকালের জন্য কোপারনিকান হয়ে গিয়েছিলেন। ছাত্রদের একটি বিতর্কে সৌরকেন্দ্রিক মতবাদকে সমর্থন করে তিনি এর পক্ষে তাত্ত্বিক ও ধর্মীয় উভয় ধরনের যুক্তিই উপস্থাপন করেন, বলেন সূর্যই মহাবিশ্বের প্রধান গতিদায়ক ও প্রাণসঞ্চালক। মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষাজীবনের শেষ দিকে অস্ট্রিয়ার গ্রাৎসে অবস্থিত প্রোটেস্ট্যান্ট স্কুলে (যেটি পরবর্তীতে ইউনিভার্সিটি অফ গ্রাৎস হয়) গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২৩ বছর বয়সে ১৫৯৪ সালে তিনি পদটি গ্রহণও করে ফেলেন।